ঐতিহাসিক পতনের মুখে বৈশ্বিক স্বর্ণ বাজার: এক আউন্সে ৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি দর সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মূল্যবান ধাতু সোনা।
তবে গত ১২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ একদিনের দরপতনের সম্মুখীন হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণের বাজার। একদিনের লেনদেনে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৬.৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে ৪ হাজার মার্কিন ডলারের (প্রায়) কাছাকাছি চলে এসেছে। বুধবার (২২ অক্টোবর, ২০২৫) সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এই চাঞ্চল্যকর তথ্য নিশ্চিত করেছে।
যদিও চলতি বছর সামগ্রিকভাবে সোনার দাম ৫৫ শতাংশ থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ এই বড় ধরনের সংশোধন বিনিয়োগকারীদের চিন্তায় ফেলেছে। সোনার পাশাপাশি রুপার দামও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
দরপতনের মূল কারণ: ডলারের শক্তিশালী অবস্থান এবং ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাবাজার বিশ্লেষণে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, এই দরপতন মূলত ‘প্রযুক্তিগত সংশোধন’ (Technical Correction)-এর ফল। তবে এর পেছনে একাধিক শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণ কাজ করছে:
ডলারের শক্তিশালী হওয়া: আন্তর্জাতিক বাজারে মার্কিন ডলার শক্তিশালী হওয়ায় স্বর্ণের চাহিদা কমেছে, কারণ ডলার-ভিত্তিক এই ধাতুটি অন্যান্য মুদ্রার বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস: বৈশ্বিক পর্যায়ে ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত ও উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ায় ‘নিরাপদ আশ্রয়’ (Safe Haven) হিসেবে পরিচিত সোনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমেছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক আলোচনার সম্ভাবনা: বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার ইতিবাচক অগ্রগতি সোনার দামে পতন ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন সফরের ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে বাণিজ্যিক শঙ্কা ছিল, তা অনেকটাই কেটে গেছে।
এই পরিবর্তনের প্রভাবে, ডিসেম্বরের ডেলিভারির গোল্ড ফিউচারের দাম ২৯.৯০ ডলার বা ০.৭৩ শতাংশ কমেছে এবং স্পট সোনার দামেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।
সোনার বাজার ও নির্ভরতা: সাধারণত, সোনার বাজার তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে:
বাণিজ্যিক বাধার শঙ্কা
যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সংঘাত
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার
যখন বৈশ্বিক শঙ্কা দেখা দেয়, বিনিয়োগকারীরা দ্রুত ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে সোনার দিকে ঝোঁকেন। এই কারণে সোনার চাহিদা বাড়ে এবং দাম আকাশছোঁয়া হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শঙ্কাগুলি হ্রাস পাওয়ায় দাম কমতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাবে বাংলাদেশেও রেকর্ড হারে কমলো সোনার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার ঐতিহাসিক দরপতনের সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে। তেজাবি স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) দাম কমার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বাজারেও মূল্যবান এই ধাতুর দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।
সবচেয়ে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনার দাম এক লাফে ৮,৩৩২ টাকা কমানো হয়েছে।
নতুন মূল্য কাঠামো: বুধবার (২২ অক্টোবর) বাজুসের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির বৈঠকের পর এই দর কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) থেকে কার্যকর হবে।
নতুন মূল্য কাঠামো অনুযায়ী বিভিন্ন মানের সোনার দাম নিম্নরূপ:
মান (ক্যারেট) পূর্বের দাম (২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকার পর) হ্রাসকৃত নতুন দাম ও কত টাকা কমল
২২ ক্যারেট (ভরি) ২,১৭,৩৮২ টাকা ২,০৮,৯৯৫ টাকা ৮,৩৮৭ টাকা
২১ ক্যারেট (ভরি) ২,০৭,৫০৩ টাকা ১,৯৯,৫০১ টাকা ৮,০০২ টাকা
১৮ ক্যারেট (ভরি) ১,৭৭,৮৫৩ টাকা ১,৭০,৯৯৪ টাকা ৬,৮৫৯ টাকা
সনাতন পদ্ধতি (ভরি) ১,৪৮,০৭৪ টাকা ১,৪২,২১৯ টাকা ৫,৮৫৫ টাকা
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: এর মাত্র তিন দিন আগে, ২০ অক্টোবর, স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়েছিল, যার ফলে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। এই দর কমানোর ফলে তা আবার অনেকটাই নিচে নেমে এলো।
রুপার দামও নিম্নমুখী: সোনার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে রুপার দামও কমানো হয়েছে। নতুন দর অনুযায়ী, ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি রুপার দাম ৫,৪৭১ টাকা, যা আগে ছিল ৬,২০৫ টাকা (কমল ৭৩৫ টাকা)।
স্বর্ণ ও রুপার এই দরপতন সাময়িক স্বস্তি এনেছে ক্রেতাদের মধ্যে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে সোনার দাম আরও কিছুটা নিম্নমুখী থাকতে পারে।
সূত্র:যায়যায় দিন








