ব্রহ্মপুত্র নদে (ইয়ালুং সাংপো) নির্মিতব্য বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে সম্প্রতি ‘শতাব্দীর সেরা প্রকল্প’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং।
পশ্চিম চীনের তিব্বত অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই প্রকল্পকে দেশটির নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ ও সবুজ জ্বালানিনির্ভর উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্পটি প্রযুক্তিগত সাফল্য বয়ে আনলেও চীনের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে এর প্রভাব সীমিত হতে পারে।
ইয়ালুং সাংপো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ১৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত জুলাইয়ে বাঁধ নির্মাণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বলেন, ‘এটি হবে দীর্ঘমেয়াদি ও বৃহৎ প্রভাববিস্তারকারী প্রকল্প, যা আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করবে।’
তবে এমন সময়ে এই প্রকল্প শুরু হয়েছে, যখন চীনের অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সম্পত্তি খাতে মন্দা, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি, অভ্যন্তরীণ ভোক্তা চাহিদার পতন এবং অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে মূল্যসংকোচন ও বাণিজ্যিক উত্তেজনা দেশটির প্রবৃদ্ধিকে শ্লথ করেছে। ফলে সরকার নতুন করে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এই প্রকল্পে আশার আলো খুঁজছে।
আগামী সপ্তাহে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ২০৩০ সাল পর্যন্ত কার্যকর নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করবে, যেখানে আত্মনির্ভরতা ও সবুজ উন্নয়নকে প্রধান অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ইয়ালুং সাংপো প্রকল্পকেও সেই কৌশলগত লক্ষ্যের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য লি দাওকুই বলেন, ‘এই প্রকল্প পশ্চিমাঞ্চলকে নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্রে রূপান্তর করবে, দেশীয় চাহিদা বাড়াবে এবং জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য আনবে।’
বিশ্লেষকরা ইয়ালুং সাংপো প্রকল্পকে চীনের ঐতিহাসিক থ্রি গর্জেস ড্যামের সঙ্গে তুলনা করছেন। থ্রি গর্জেস ছিল ১৯৯০-এর দশকে নির্মিত বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা এশিয়ার আর্থিক সংকটকালে চীনের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সহায়তা করেছিল।
তবে বর্তমান প্রকল্পটির আকার ও ব্যয় আগের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন- এত বড় বিনিয়োগ কি সত্যিই চীনের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে, নাকি অবকাঠামো ব্যয়ের কার্যকারিতা আগের মতো নেই?
কর্তৃপক্ষের ধারণা, প্রকল্পটি বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট–ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যা চীনের গৃহস্থালি বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রায় ২০ শতাংশ। নির্মাণে প্রয়োজন হবে প্রায় ৪ কোটি টন সিমেন্ট ও ৪০ লাখ টন ইস্পাত, এবং সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে লক্ষাধিক মানুষের।
বাঁধ ঘোষণার পর থেকেই চীনের সিমেন্ট, বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ও প্রকৌশল কোম্পানির শেয়ারদরে উল্লম্ফন দেখা গেছে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিগওয়ান ল্যাবস-এর ডাটা ম্যানেজার অ্যাম্বার ঝাং বলেন, “থ্রি গর্জেস ড্যাম যেমন চীনের জাতীয় গর্ব ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল, ইয়ালুং সাংপো তেমনই নতুন প্রবৃদ্ধির ‘সুপার-সাইকেল’ সূচনা করতে পারে।”
অন্যদিকে, হংকংভিত্তিক লোটাস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট-এর প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা হাও হং প্রকল্পটিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হুভার ড্যামের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, ‘এই প্রকল্প পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে উৎপাদকদের মুনাফা বাড়াবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং মূল্যসংকোচনের ভয় কমাবে- যা চীনের অর্থনীতিতে ইতিবাচক চক্র তৈরি করতে পারে।’
তবে কিছু অর্থনীতিবিদ এ বিষয়ে সতর্ক। নোমুরার লু টিং, সিটিগ্রুপের জিয়াংরং ইউ এবং ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের লিয়া ফাহি মনে করেন, প্রকল্পটির প্রভাব প্রাথমিক পর্যায়ে চীনের জিডিপিতে বছরে সর্বোচ্চ ০.১ শতাংশ হতে পারে।
ম্যাককয়ার গ্রুপের ল্যারি হু বলেন, ‘একটি বড় বাঁধ নির্মাণ অর্থনীতিকে চাঙা করার আরেক ধাপ নয়; চীনের প্রবৃদ্ধি এখন ভোক্তাব্যয়ের ওপর নির্ভর করা উচিত।’
অন্যদিকে, মর্নিংস্টারের জেফ ঝাং ও সুইস ব্যাংক জুলিয়াস বেয়ারের বিশ্লেষক কারস্টেন মেন মনে করেন, প্রকল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের পরিমাণ বিশাল মনে হলেও, চীনের বিশাল নির্মাণবাজারে এটি তেমন প্রভাব ফেলবে না। সর্বোপরি, পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রকল্পটি চীনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রতিশ্রুতির প্রতীক হলেও, এর অর্থনৈতিক প্রভাব কতটা স্থায়ী হবে তা সময়ই বলে দেবে।
সূত্র :যায়যায় দিন








