দারাজের ১০ বছরের যাত্রা কেবল অনলাইন কেনাকাটার গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠার এক নকশা। দশ বছর আগে ই-কমার্স ছিল পরীক্ষামূলক—অনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আর সীমিত আস্থার এক নতুন ধারণা। আজ এটি হয়ে উঠেছে প্রতিদিনের স্বাভাবিক অভ্যাস। আর দারাজের পথচলা—ছোট্ট উদ্যোগ থেকে শুরু করে শিল্পের মানদণ্ডে পরিণত হওয়া—প্রমাণ করে, ধৈর্যশীল বিনিয়োগ ও দূরদর্শী কৌশল কীভাবে একটি শিল্পকে বিকশিত করতে পারে।
আজ রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত জেলা পর্যন্ত হাঁটলে চোখে পড়বে কমলা রঙের ডেলিভারি ব্যাগ, ব্যস্ত মোড়ে কালেকশন পয়েন্ট কিংবা সেই প্রজন্ম, যাদের কাছে অনলাইন কেনাকাটা এখন স্বভাবসিদ্ধ। এটি হঠাৎ করে হয়নি। এর পেছনে আছে বছরের পর বছর টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ ও নিরলস বিনিয়োগ। শুরুর দিনে যখন ভোক্তাদের আস্থা কম, লজিস্টিকস সীমিত, তখনও দারাজ বিশ্বাস করেছিল—যদি সহজ অভিজ্ঞতা, নির্ভরযোগ্যতা আর আস্থার ভিত্তি তৈরি হয়, তবে অভ্যাসও
দারাজের “পাইপস ফার্স্ট” কৌশলের প্রথম রূপ ছিল নিজস্ব লজিস্টিকস সেবা— দারাজ এক্সপ্রেস (ডেক্স)। আজ এটি দেশের অন্যতম আধুনিক লজিস্টিকস নেটওয়ার্ক, যা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিদিন হাজারো গ্রাহকের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি, স্থানীয়ভাবে তৈরি আইওটি-সক্ষম ‘ডিজিবক্স’ পার্সেল সংরক্ষণ ও হস্তান্তরকে করেছে আরও নির্ভরযোগ্য, আর লাস্ট-মাইল ডেলিভারিকে করেছে সহজ ও কার্যকর।
শুধু তাই নয়, অন্য ব্যবসায়ীদের সেবা দেওয়ার জন্য কুরিয়ার লাইসেন্স, এবং ডিজিটাল লেনদেনকে এগিয়ে নিতে পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার অনুমোদন—এসব উদ্যোগ দারাজকে কেবল একটি প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং সমন্বিত অবকাঠামোর অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অবকাঠামো কেবল মঞ্চ প্রস্তুত করে, কিন্তু দক্ষ কমিউনিটি গড়ে তোলে আসল পরিবর্তন। দারাজ, ১১.১১-এর মতো ক্যাম্পেইনকে রূপ দিয়েছে জাতীয় কেনাকাটার উৎসবে। এক দিনে লাখো প্যাকেজ ডেলিভারি করা শুধু দক্ষতার প্রমাণ নয়—এটি ভোক্তার আস্থার ভিত্তিকে করেছে আরও দৃঢ়।
একইসাথে, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য দারাজ হয়ে উঠেছে আশার দ্বার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আজ দেশের প্রতিটি কোণে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন। দারাজ ইউনিভার্সিটির ফ্রি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে হাজারো উদ্যোক্তা ডিজিটাল সাক্ষরতা, মার্কেটিং ও অনলাইন অপারেশনে দক্ষ হয়েছেন। এছাড়া দারাজ মার্কেটিং সলিউশনস (ডিএমএস) ব্র্যান্ড ও এসএমইদের প্রাথমিক ডেটা সঞ্চালন ও কার্যকর বিজ্ঞাপনের সুযোগ দিচ্ছে, যা বিক্রির পথকে করছে আরও সহজ ও কার্যকর।
আজ ই–কমার্স খাতে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। তাদের ভেতর নারী কর্মীদের সংখ্যা কম নয়। দারাজে নারী কর্মীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নিয়ে চালু করেছে “ডিওমেন” উদ্যোগ। এর মধ্যে আছে—‘শি সাইনস’ যা দারাজের সেরা নারী কর্মীদের স্বীকৃতি দেয়, উন্মুক্ত আলোচনার জন্য আছে ‘ডায়ালগ ফোরাম’, আর জুনিয়র নারী সহকর্মীদের জন্য মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম। এটি করপোরেট সংস্কৃতিতে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
একইসাথে ভবিষ্যতের প্রতিভা বিকাশে দারাজের ফিউচার লিডার্স প্রোগ্রাম (ডিএফএলপি) একটি ১৫ মাসব্যাপী ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি উদ্যোগ, যা আগামী দিনের ডিজিটাল নেতাদের গড়ে তুলছে। এ বছর নতুন পাঁচজন গ্র্যাজুয়েট এই প্রোগ্রামে যুক্ত হয়েছেন, এর পাশাপাশি আরও বহু তরুণ পেশাজীবী যোগ দিয়েছেন দারাজের বিভিন্ন বিভাগে।
তবে এই যাত্রা সবসময় মসৃণ ছিল না। নকল পণ্য, কিছু প্ল্যাটফর্মের অনিয়ম, হঠাৎ কমিশনে ভ্যাট বৃদ্ধি, একক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অভাব এবং এখনো চূড়ান্ত না হওয়া ক্রসবর্ডার নীতি—এসবই খাতের প্রবৃদ্ধির পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই কারণেই সরকারি অংশীদারিত্ব অত্যন্ত জরুরি। দারাজ ইতোমধ্যেই ক্রেতা-বান্ধব ও স্বচ্ছ একটি কাঠামো গড়ে তুলেছে—যেখানে আছে রেটিং-রিভিউ সিস্টেম, সরাসরি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ, এবং “দারাজ মল” ট্যাগের মাধ্যমে ব্র্যান্ডেড ও নির্ভরযোগ্য বিক্রেতাদের আলাদা চিহ্নিত করার ব্যবস্থা। একইসাথে প্ল্যাটফর্ম গভর্নেন্স নীতিমালার মাধ্যমে অসঙ্গত বিক্রেতাদের শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে সবার জন্য ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
কিন্তু খাতটিকে সত্যিকারের জাতীয় শিল্পে রূপ দিতে হলে সরকারের সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য। একক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গড়ে উঠলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমবে, ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষিত হবে এবং প্রবৃদ্ধির পথ ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি, বহুল প্রত্যাশিত ক্রসবর্ডার নীতি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন এবং স্থানীয় উৎপাদনও পৌঁছে যাবে আন্তর্জাতিক মানে।
সময়ের এই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে, ই–কমার্স খাত কেবল একটি সেক্টর নয়—বরং দেশের পরবর্তী প্রধান শিল্প হিসেবে জাতীয় অর্থনীতির নতুন ইঞ্জিনে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার এখন প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মোট খুচরা বিক্রির মাত্র ৩–৫ শতাংশ এখনো অনলাইনে হয়। সামনে অবারিত সম্ভাবনা। এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হলে বাড়াতে হবে ডিজিটাল সাক্ষরতা, নিশ্চিত করতে হবে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ এবং আস্থার টেকসই ভিত্তি।
আজ দারাজ শুধু একটি নাম নয়—এটি দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের আস্থার ঠিকানা। সম্প্রতি হাইসেন্স, অনার, ক্রোকোডাইল বিডি ও নিউজিল্যান্ড ডেইরির মতো ব্র্যান্ড প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে, যা প্রমাণ করে—দারাজ দ্রুত সম্প্রসারণের পাশাপাশি আস্থা ও স্থায়িত্বকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে।
এক দশকের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে—যখন অবকাঠামো, সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি আর ধৈর্যশীল বাস্তবায়ন একত্রিত হয়, তখন অসম্ভবও সম্ভব হয়। এখন আমাদের কাজ হলো এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নয়, জাতীয় পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া। আমাদের অঙ্গীকার স্পষ্ট- একটি স্থিতিশীল ও টেকসই ই-কমার্স ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা, যা ভোক্তা, উদ্যোক্তা ও অংশীদার—সবাইকে সমৃদ্ধ করবে, এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হবে।
সূত্র :যায়যায় দিন