মূলত মাহফুজের ওই স্ট্যাটাস ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। এ নিয়ে জামায়াত ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাহফুজ আলমকে জড়িয়ে নেতিবাচক পোস্ট করতে দেখা যায়।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি যে রাজনৈতিক শুদ্ধিতার আলাপ যিনি দিয়েছেন, একাত্তর প্রশ্নে সেই প্রশ্নের আসলেই মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ একাত্তেরর চেতনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং জামাতের একাত্তরের যে ভূমিকা, জামায়াতও তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে। এ কারণে একাত্তর ইস্যু বারবার ঘুরে ফিরে আসে।’
এর পরদিন মাহফুজ আলম আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘আমাকে নিয়ে নোংরামি করতেসো, ঝামেলা নাই। ফ্যামিলি টাইনো না, যুদ্ধাপরাধের সহযোগী রাজাকারেরা। এটা লাস্ট ওয়ার্নিং। আর যে চুপা শিবিররা এ সরকারে পদ বাগাইসো আর বিভিন্ন সুশীল ব্যানার খুলে পাকিস্তানপন্থা জারি রাখসো, তোমারা তোমাদের পূর্বপুরুষ রাজাকার আর দালালদের তুলনায় আরো বেশি ভুগবা।’
এই পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে অবশ্য স্ট্যাটাসটি নিজের ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তবে স্ট্যাটাসের স্কিনশট দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়। এসব বিষয় নিয়ে মাহফুজ আলমের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।
ক্ষুব্ধ জামায়াত-শিবির
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি গঠনের পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে জামায়াত শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে অনেককেই সমালোচনা করতে দেখা গেছে। যদিও গণ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের এই সংগঠনটি বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছিল।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ বৃহস্পতিবার যে অবস্থান কর্মসূচিতে ডাক দিয়েছিলেন সেখানে জামায়াত শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকেই অংশ নিতে দেখা যায়।
একই মঞ্চে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সফলতা আসার পর কেন হঠাৎ জামায়াত শিবিরকে ইঙ্গিত করে এই ধরনের পোস্ট দিয়েছে মাহফুজ আলম, সেটি নিয়েও প্রশ্ন জামায়াত ও শিবিরের শীর্ষ নেতাদেরও।
শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে হাসনাত আব্দুল্লাহ অগ্রসর ভূমিকা পালন করছে। হাসনাত প্রশংসায় ভাসছেন। সেখান থেকে দৃষ্টি তার (মাহফুজ আলম) দিকে ফেরাতে হয়তো এমনভাবে লিখেছেন। তিনি জানেন এতে বিতর্ক তৈরি হবে, ইন্টেনশনালি সেইদিকে ইন্ডিকেট করছেন। অনলাইনে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য করা হচ্ছে। এই জাতীয় কর্মকাণ্ডগুলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকার করেছে।’
শাহবাগে গোলাম আযমকে নিয়ে শ্লোগান কিংবা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধার বিষয়গুলো নিয়েও শিবির সেক্রেটারিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে স্ট্যাটাস না দিয়ে যারা জাতীয় সংগীতে বাধা দিয়েছে বা অন্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত ছিল।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান প্রশ্ন রাখেন, একজন উপদেষ্টা একটি রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলেছেন- সেটা কী তিনি বলতে পারেন?
তিনি বলেন, ‘তিনি (মাহফুজ) উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে রাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। এটা তার শপথের সাথে সাংঘর্ষিক। কেউ যদি রাজনীতি করতে চায় তার উপদেষ্টা পদ থেকে সরে এসে রাজনীতি করা উচিত।’
এ নিয়ে জামায়াত ও শিবির নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও করেছে। সেখানে কেউ কেউ মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দাবি তুলবে কী-না সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি বলে জামায়াত ও শিবিরের নেতারা জানান।
এর আগে গত মার্চে জামায়াত নিয়ে মাহফুজ আলমের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে নানা বিতর্ক দেখা গেছে। সে সময় জামায়াত নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল।
অস্বস্তিতে নাগরিক পার্টিও
জুলাই আগস্টের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি দলটি গঠনের পর থেকেই জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্র শিবিরের সাথে এক ধরনের রাজনৈতিক মিত্রতাও ছিল। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবিতে একসাথে আন্দোলনও করেছে জামায়াত-এনসিপি। এছাড়াও শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এই দুটি রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মিত্রতাও ছিল।
শনিবার জামায়াত ইস্যু ঘিরে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস ঘিরে দল দুটির মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েনও তৈরি হয়। এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ জামায়াত ইস্যুতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস ঘিরে যে সমালোচনা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে অস্বস্তির কথাও বলেছেন।
সোমবার এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ তার ভেরিফাইড ফেসবুক একাউন্টে লিখেন, ‘এমন বিভাজন আর বিভক্তি কারো জন্যেই কল্যাণ বয়ে আনবে না। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যে বিভক্তি কিংবা বিভাজনকে আপনারা উস্কে দিচ্ছেন, এর পরিণতি পুরো জাতিকেই ভোগাবে। শুধুই বলব আপনারা ফাঁদে পড়েছেন, অথবা অজান্তে নিজেরাই নিজেদের জন্যে ফাঁদ তৈরি করছেন।’
এনসিপির পক্ষ থেকে সোমবার একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নে সহযোগী হবে।’
এনসিপির একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপদেষ্টা পরিষদে থাকলেও দলের নেতাদের ওপর মাহফুজ আলমের প্রভাব রয়েছে। যে কারণে তার ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে।
দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জুলাইতে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সবার মধ্যে যে ঐক্য হয়েছিল সেই ঐক্য চলমান অবস্থাতেই আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার নিজস্ব মতাদর্শ, নিজস্ব রাজনীতি ও মত ভিন্নতা সেটা গণতন্ত্রের চর্চার জন্য সুস্থভাবে যদি হয় তাহলে সেটাকে সাধুবাদ জানানো উচিত।’
তবে, এটিও বলেছেন যে, এর অর্থ এই নয় যে সকল রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দলকে একই সুরে কথা বলতে হবে।
রাজনৈতিক কৌশল নাকি দ্বন্দ্ব
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অংশ হন ছাত্র প্রতিনিধিরাও। প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও পরবর্তীতে গত ফেব্রুয়ারি নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামে রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।
দল গঠনের পর থেকেই কয়েকজন নেতার নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ঘিরে শুরুতে কিছু সমালোচনা তৈরিও হয়। বিএনপির সাথে এনসিপির অনেকটা প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা গেছে গত তিন মাসে। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে এনসিপি ও জামায়াত-শিবিরের সাথে রাজনৈতিক মিত্রতাও ছিল।
এমনকি এনসিপি নেতাদের ডাকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শিবিরের নেতাকর্মীরা ছিল। নিষিদ্ধের ঘোষণার পরপরই হঠাৎ দ্বন্দ্ব কতটা স্বাভাবিক?
এই প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দুটি ব্যাখা দিচ্ছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন সফল। সেটির কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব হতে পারে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে এটা একটি কৌশলও হতে পারে।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের কর্তৃত্ব নিয়ে জামায়াত শিবির ও এনসিপির মধ্যে রশি টানাটানি ছিল। সেখানে দুই দলের থেকে কিছু মতপার্থক্য হয়েছে।’ মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে দুই দলের অবস্থানগত কারণে এই দ্বন্দ্ব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তবে তিনি এটিও বলছেন যে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল গঠনে এনসিপির সাথে জামায়াত-শিবিরের একটি সখ্যতা ছিল। সেই দিক বিবেচনায় এটি কৌশলের অংশ কী-না সেই প্রশ্নও করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘বিএনপির সাথে এক ধরনের রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে এনসিপির। সেখান থেকে জামায়াতের সাথে এক ধরনের সখ্যতা রয়েছে দলটির। সেদিক বিবেচনায় আপাত দৃষ্টিতে এটিকে দ্বন্দ্ব মনে হলেও হতে পারে এটি কৌশলগত পাতানো খেলা।’
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সামনের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকার ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর সাথে এনসিপির দূরত্ব প্রকাশের একটি চেষ্টা হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত এই বিরোধের ফলাফল কি দাঁড়াবে, এটি কি আরো বিস্তৃত হবে নাকি সামনে আবার কোনো ইস্যুতে দুই দলকে একই ছাতার তলে দেখা যাবে, সেটা দেখার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।